কবিতাসমগ্র: ‘২৪ এর গনঅভ্যুত্থান

আমি চেয়েছিলাম মেট্রো স্টেশন হতে - রিশি কাব্য

আমি আসলে চেয়েছিলাম
মেট্রো স্টেশন হতে,
যার ধ্বংসে কান্না ধরে রাখা যায় না।
হতে চেয়েছিলাম টোল প্লাজা,
যা আগুনে পুড়লে হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়,
কিংবা চেয়েছিলাম ডাটা সেন্টার হতে
যার জন্যে গোটা দেশের মানুষ আহাজারী করে।
আমি হতে চেয়েছিলাম সিটি কর্পোরেশন এর
ওয়েস্ট ডাম্পিং ট্রাক,
যা আগুনে পুড়লে ক্ষতির পরিমান করতে
ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়।
কিন্তু আমাকে ছাত্র করে পাঠালেন,
যে মরলে কান্না আসে না ,
যার রক্তে কোটি টাকার লোকসান হয় না ,
যে মরলে কেউ দেখতে আসেনা ,
রাষ্ট্রীয় ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় আসেনা আমার নাম,
যার লাশ মর্গে নিছক একটা সংখ্যা….
অথচ ‘আমি কতো কি হতে চেয়েছিলাম.!

এই শহরে পাখিদের ঘুম ভাঙ্গে গুলির শব্দে - রিশি কাব্য

এই শহরে পাখিদের ঘুম ভাঙ্গে গুলির শব্দে
এই শহরে ছাত্র পড়ে থাকে মগজ ভর্তি বারুদের গন্ধে
মস্তিষ্ক ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে শকুন এর গুলি
রক্তের দাবানলে ভেসে যাচ্ছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা
ফ্যাসিষ্ট কারা? স্বৈরাচার কে?
শকুন এর ভয়ে থাকে ঘরে কে ?
মায়ের বুকের আর্তনাদ-
হামার বেটাকে মারলু কেনো?
তৃষ্ণার্ত কালো র‍্যাব,
পানি লাগবে আর কারো?
শহর যখন নির্ঘুম মুগ্ধ, প্রিয়,সাঈদ এর রক্তে,
তখন বেওয়ারিশ লাশেদের দ্বন্দ্বে কোথাও কেউ নেই ।
কাঁটাতার ফেলে আসা খাকি হায়েনার শব্দ বোমায়
ঢেকে যাচ্ছে মুক্তির স্লোগান
টিয়ারশেল এর ধোঁয়ায় নিখোঁজ হচ্ছে লাশ
প্লেন এর শব্দের পিছু নিয়ে মাইল পাড়ি দেওয়া থেকে
হেলিকপ্টার এর শব্দে আতংক লাগার সময়ে আজ
এই শহরে পাখিদের ঘুম ভাঙ্গে গুলির শব্দে
এই শহর নেশায় বুদ বারুদের গন্ধে।।

গোল্ডফিশের কান্না - রওশন আরা মুক্তা

একটা বিল্ডিং-এর মূল্য
তোমার ছেলের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি।
একটা ওভারব্রিজের দাম
তোমার হাজার ছেলের লাশ দিয়েও কি চুকাতে পারবে?
একটা মেট্রোস্টেশন কি গর্ভে ধরতে পারবে তুমি?
কী আছে তোমার অপত্য স্নেহে?
গাড়িগুলো বাসগুলো যে পুড়ে গেল
তোমার ছেলেদের রক্তমাংসে তো আর
চলবে না এদের ইঞ্জিন!
মেট্রো কি আর তোমার ছেলেদের
দু:সাহসের বিদ্যুতে ছুটবে?
বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল কি
তোমার জানাজার কান্নায় আদায় হবে?
কী করে জন্ম দিলে এমন সন্তান?
ভয় পায় না দিতে জান!
যেদিন তোমার পেটে ধরতে পারবে
আস্ত একটা মেট্রোরেল,
যেদিন তোমাদের কোলে দোলাতে পারবে
একটা গোটা দেশের ডেটা সেন্টার
যেদিন তোমার স্তন থেকে দুধ না
ঝরবে বিটিভির বাম্পার ফলনের সংবাদ
যেদিন তোমরা মানুষের বাচ্চা না,
জন্ম দিবে বাস-ট্রাক, ওভারব্রীজ
সেদিন বুঝতে পারবে,
একটা বিল্ডিংয়ের মূল্য
তোমার রক্ত-মাংসের সন্তানের চেয়ে
আসলেই অনেক বেশি।
তখন চুমু খেয়ো ঐ ইট সিমেন্টের শরীরে
গাড়িগুলোকে পাশে শুইয়ে দিও হাত বুলিয়ে
পদ্মাসেতুটাকে পাঠিও ভার্সিটিতে,
পাবলিকে নাহয় প্রাইভেটে
আর রাতে ঘরে ফেরার অপেক্ষা করো
প্রিয় ওভারব্রীজ-টার, স্টেশন-টার।
মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিও বিটিভি-টাকে।
‘বাবা’ বলে ডেকো শখের মেট্রোরেল-টাকে।
আর ভুলে যেও, সব ভুলে যেও।
রক্ত মাংসের কোনো ছেলে ছিল তোমার
পেটে ছিল পিঠে ছিল কোলে ছিল
ভুলে যেও, তুচ্ছ নগণ্য ঐ মনুষ্য সন্তান
কখনও তোমাকে মা ডেকেছিল
তোমার ঘরে এখন বিটিভি,
তোমার বিছানায় এক্সপ্রেসওয়ে
তোমার আচল ধরে আছে মেট্রোরেল
আর কী চাই তোমার?
যাও চুমু খেয়ে নাও ভবনটাকে, চেয়ারটাকে, হেলিকপ্টার-টাকে!
তারপর ঘুমিয়ে যাও
সকালে আবার তোমার বিল্ডিংগুলোর ক্লাস আছে।

রক্তাক্ত জুলাই - জাহিদ প্রীতম

ভেবেছিলাম সারা জুলাই জুড়ে লিখব
ভালবাসার গীতিকাব্য,
আসছে ফাল্গুনে শোনাব
বুক পকেটে জমা
প্রেমের গল্প।
অথচ আমার প্রিয় জুলাই
থমকে গেল
রক্তাক্ত অমানিশায়!
বিদ্রোহী বারুদের ঘ্রাণে ,
শহীদের তাজা রক্ত-প্লাবনে-
প্রেমের গল্প কী লেখা যায়?
এ সময় প্রমিকারাও যে
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
তাই ভাবছি,
আসছে ফাল্গুনে শোনাব
দ্বিগুন হবার গান!
শোনাব রক্তাক্ত জুলাইয়ে
সন্তান হারা মায়ের আর্তনাদ

আমি আর কবিতা লিখবো না - অজানা

আমি আর কবিতা লিখবো না।
আমি এখন ইতিহাস লিখব, একটা যুগের ইতিহাস ,একটা জাতির ইতিহাস।

ইতিহাসের প্রথম পাতায় আমি কিছুই না লিখে ,সেখানে এক জোড়া জুতো এনে রেখে দেব।
সেই জুতো ,
যে গুলো মানুষ চুরি হয়ে যাওয়া ভয়ে উপাসনা করার সময় উপাসনালয়ের ভিতরে নিয়ে রাখতে হয়।
পরবর্তী প্রজন্ম এগুলো দেখেই বুঝতে পারবে আমাদের চরিত্র কেমন ছিল।

আমি গ্রামের বাজারে গিয়ে দশজন গিরস্তের কাছ থেকে দশ ফোঁটা দুধ কিনে এনে রেখে দেব এখানে।
আমি জানি ,রহস্য উদঘাটনের জন্য মানুষ এগুলোকে রান্না করা শুরু করবে।
অনেকক্ষণ রান্না করার পরও যখন এখান থেকে মালাই হবে না, দই মাখন হবে না, মানুষ তখন বুঝতে পারবে আমাদের বেচাকেনার মান কেমন ছিল, ব্যবসায়ীক নৈতিকতা কেমন ছিল।

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সুন্দর ও চাকচিক্যময় কিছু উপাসনালয়কে আমি রেখে দেব এর ভিতর।
ইতিহাস পাঠকরা যখন দেখবে উপাসনালয় গুলো সোনা রুপা মোড়ানো, আর উপাসনালয়ের সামনে বসে থাকা ভিক্ষুকদের কারো মুখে খাবার নেই ,কারো গায়ে পোশাক নেই।
পাটকরা তখন আমাদের ধর্মীয় জ্ঞান এবং গোড়ামী দুটো সম্বন্ধেই পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারবে।

আমি টাটকা নতুন কয়েকটা ১০০ টাকার নোট এনে ইতিহাস বইয়ের পাতার সাথে গেঁথে রেখে দেব।
এটা দেখে পাঠকরা প্রথমে কিছু বুঝতে পারবে না, ভালো করে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখার পর তারা লক্ষ্য করবে যে ,প্রতিটি টাকার এক কোনে পোড়া। তখন তারা বুঝতে পারবে এগুলো দিয়ে যুবকরা নেশা করত।

আমি হাসপাতাল থেকে ইচ্ছে করে ফেলে দেওয়া কিছু ভ্রুন, খাল, বিল, জঙ্গল থেকে ফেলে দেওয়া নবজাতকের কিছু রক্ত মাংস হাড় এনে রেখে দেব এখানে।
বইয়ের পাতা খুলতেই ওরা কান্না শুরু করে দেবে, ওরা চিৎকার করে বলবে আমরা নির্দোষ ছিলাম , আমাদেরকে অন্যায় ভাবে হত্যা করেছিল ওরা।
ওদের কথা শুনে জ্ঞানী মূর্খ সবাই আমাদের বর্বরতা সম্বন্ধে অনুমান করতে পারবে।

বন্দিসহ আস্ত একটা জেলখানা এনে আমি রেখে দেবো এর ভিতর।
মানুষেরা যখন দেখবে এর ভিতর কোন অপরাধী নেই,আছে শুধু রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার এবং ক্ষমতাসীনদের চক্রান্তে স্বীকার কিছু নিরপরাধ মানুষ।
তখন বুঝতে পারবে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থা এবং বিচার ব্যবস্থা কেমন ছিল।

কোন এক সুন্দরী বধুর সুন্দর হাতে লেখা একটা প্রেমের চিঠি এনে রেখে দেবো এখানে।
চিঠির ভাষায় মানুষ আবেগ আপ্লুত হয়ে যাবে, তবে চিঠির ঠিকানা দেখার পর সবাই হতভম্ব হয়ে যাবে।
মানুষ যখন দেখবে এ চিঠি বধু তার স্বামীকে লিখেনি ,লিখেছে তার গোপন প্রেমিককে, তখন তারা আমাদের পারিবারিক অবস্থার কথা ভালোভাবে বুঝতে পারবে।

একজন পিতা আরেকজন পুত্রকে এনে রেখে দেবো এখানে আমি।
মানুষ যখন দেখবে বৃদ্ধ পিতা বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে কাঁদছে, কিন্তু তার সম্পদশালী ছেলে তার কোন খোঁজ খবর নিচ্ছে না, তখন তারা আমাদের স্নেহপরায়ণতা ও দায়িত্বশীলতা সম্বন্ধে জানতে পারবে।

আমি বিশ্বকাপসহ বড় বড় কিছু প্রতিযোগিতার পুরস্কারের ট্রফি থেকে কিছু সোনা রুপা এনে রেখে দেবো এখানে।
ইতিহাস পাঠকরা যখন দেখবে দুনিয়া জুড়ে অসংখ্য মানুষ খাদ্য পানীয় এবং চিকিৎসার অভাবে ভুগছে, কিন্তু মানুষেরা এদিকে দৃষ্টিপাত না করে সবাই প্রতিযোগিতার ট্রফি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে, পাঠকরা তখন আমাদের বুদ্ধি বিবেকের জীর্ণতা ও রুগ্নতা সম্বন্ধে ধারণা করতে পারবে।

শিক্ষাগুরুর যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করা কোন এক কিশোরীর ফাঁসির দড়িটা এনে রেখে দেবো আমি। সাথে তার লেখা চিরকুটটিও থাকবে।
ইতিহাস পাঠকরা চিরকুটটি পড়ে যা বোঝার তাই বুঝবে।

রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মা হয়ে যাওয়া পাগলিটাকেও আনবো আমি।
ইতিহাস পাঠক পাগলীর পেটে থাকা বাচ্চার বাবার সন্ধান না পেয়ে, বুঝতে পারবে সে যুগে নারীর ইজ্জত কতটা নিরাপদ ছিল।

সর্বশেষ পাতায় আমি আমার কলমটা রেখে দেবো।
মানুষেরা কলমটি হাতে নেওয়ার পর যখন এটার মধ্য থেকে কালি না পড়ে চোখের পানি পড়বে ,রক্ত পড়বে,তখন তারা বুঝতে পারবে সে যুগে সত্য কথা বলার কলম এবং কবি কোনটাই নিরাপদ ছিল না।

আমার রক্তে বাংলাদেশ - অভিক রায়

রঙে রঙে আকাশটা লাল, বৃষ্টি আগুন রক্তঝরা
তোমার আমার কাব্য দেখ গুলির দাগে ছন্নছাড়া
দেশের বুকে চালিয়ে গুলি রক্ত তুমি করেছ পান
দেশের বুকে জ্বলছে আগুন, দেশকে করেছ মহাশ্মশান
সূর্যরঙা কৃষ্ণচূড়ায় রুধির লালের খবর পাই
কার আঙুলের ঐ ইশারায় রক্ত দিলো আমার ভাই
তোমার গুলি বুক চিড়েছে কাদের তুমি পাওনি খোঁজ
একলা সাঈদ মরেনি হোথায়, রক্ত দিচ্ছে দেশটা রোজ
বানিয়ে সেতু, রাস্তা, রেল কে ভেবেছে গড়েছে দেশ
দেশটা কি রে ইট আর পাথর? মানুষ, মানুষ, মানুষই দেশ
পতাকা থেকে সবুজ কেড়ে বয়েছে রক্ত চোখ দিয়ে
রাতদিন দেখ চলেছি কেঁদে কত লাশ মোরা বুকে নিয়ে
রক্ত, রক্ত, রক্ত কাদের? কার রক্তে লাল এ দেশ?
মুগ্ধ আমি, মুগ্ধ তুমি, আমার রক্তে বাংলাদেশ

আমি শেষ বিদায় নিব না - সোয়েব মাহমুদ

আমি শেষ বিদায় নিবো না
আমি জানি – আমি জানি আমাদের আবার দেখা হবে
তর্কে বিতর্কে মান অভিমানে কবিতায়
আর্জেন্টিনা ব্রাজিল বাহাসে
আমাদের দেখা হবে লিভারপুল আর্সেনাল চেলসি সিটি বাহাসে

প্রচুর কবিতা পড়বো
আমি জানি খুব জোরে খুব জোরে গাইব গ্লানিহীন জাতীয় সঙ্গীত
স্বৈরাচারমুক্ত স্বাধীন আকাশের নিচে কবিতা পড়বো
আবার বেহুশপতিবারে মাতলামি করবো
আমি জানি জয় আমাদের হবেই

আমাদের দেখা হবেই স্বাধীন দেশের মুক্ত আকাশে
রিক্সায় টইটই করে ঘুরব
বইমেলায় যাব
সমুদ্র দেখব

আমি জানি যদি আমি ফিরে না’ও আসি,
আমাকে মনে রাখবে বাংলা কবিতা
মনে রাখবেন আপনারা যে কি না একটা স্বাধীন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় ছিলো
মনে রাখবেন আপনাদের খুব কাছাকাছি স্বাধীনতার স্বপ্নে
বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নে
ধর্মীয় রাজনীতিমুক্ত বাক-স্বাধীনতার সূর্য দেখার স্বপ্নে বিভোর
একজন মাতাল সার্কাসম্যান, ব্যর্থ চ্যাপলিন ছিলো

কি মনে রাখবেন তো যদি না ফিরে আসি?
যদি দেখা না হয়?
ভুলে যাবেন না’তো?

আম্মার পায়ের কাছে বসেছিলাম
মন বলছে আমরা জিতবোই
এত রক্ত বৃথা যাবে না
দেখা হবেই,কি বলেন?
গ্লানিহীন জাতীয় সঙ্গীত গাইব না, আমরা?

Scroll to Top