লেখক: Anupam Shaikat Shanto
কোটা আন্দোলনকারীদের মেরে ফেলার ছবি-ভিডিওগুলো দেখার মানসিক শক্তি ছিল না বিধায় এরকম কিছু এলেই দ্রুত স্ক্রল করে নীচে নেমে গিয়েছি, সেগুলো এভোয়েড করেছি। কখনো কখনো এমন ছবি-ভিডিও শেয়ার করেছি বা লিংক কপি করে আমার একটা তালিকা পোস্টের নীচে কমেন্টে জমা করেছি, কিন্তু সেগুলো নিজে দেখছিলাম না। এমনকি আবু সাঈদের বুক পেতে গুলি খাওয়ার ভিডিওটাও দেখার মত সাহস করতে পারিনি। কিন্তু, একজনের পোস্টে পড়লাম, তিনি মানসিক ট্রমা হবে জেনেও, রাতে ঘুমাতে পারবেন না, জেনে – বুঝেও এই ছবি ও ভিডিওগুলো খুঁটে খুঁটে দেখছেন, দেখছেন এই কারণে যে – এই স্মৃতিগুলো যেন কখনো না ভুলেন! আমিও চিন্তা করলাম, বিদেশে আরামে বসে ভালো থাকতে, ভুলে থাকতে, ভুলে থেকে নিজের মত করে জীবন কাটাতে কেন এগুলো না দেখে থাকবো? যারা দেশে থেকে, ছবি বা ভিডিওতে না, বরং বাস্তবে সামনা সামনি নিজ চোখে দেখেছে, যারা গুলি খেয়েছে, মার খেয়েছে, গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হওয়া ভাই বা বোনটিকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে, বা যে মা – বাবা তার সন্তানের মৃত লাশের উপরে আছড়ে পড়ছে, তাদের ট্রমার কাছে তো আমার নিরাপদ দূরত্বে বসে ছবি-ভিডিওগুলো দেখার ট্রমা কিছুই না! তাই, একটু একটু করে ভিডিওগুলো দেখা শুরু করলাম!
এক ছাত্রীর লাশের উপরে তার মা বিলোপ করতে করতে আছড়ে পড়ছেন! আরেকটা ছেলে – তার খোলা বুকটা রাবার বুলেটের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে, সেই ছেলেটার লাশের উপরে তার পাগলপ্রায় মা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন! একজন মা কিভাবে তার সন্তানের এমন লাশ দেখতে পারেন? রাস্তায় একজন রিকশাচালকের হাউমাউ করে কান্নার ভিডিও দেখলাম, ছেলের গুলি খেয়ে মরার খবর পেয়েছেন তিনি! এক বড়বোনের ভাই হারানোর বিলাপ শুনলাম! স্বজন হারানোর কষ্ট সবসময়ই সবচেয়ে তীব্র, কিন্তু এভাবে নিজ রাষ্ট্রের লেলিয়ে দেয়া বাহিনীর হাতে সন্তানের, ভাইয়ের/ বোনের, বন্ধুর, প্রিয়জনের মৃত্যু, কিভাবে মেনে নেয়া সম্ভব?
এই প্রচণ্ড কষ্টের ভিডিওগুলো কোনরকমে থেমে থেমে দেখা শেষ করে, সাহস করে ভয়ানক ভিডিওগুলো দেখা শুরু করলাম। একটা সরু গলিতে (উপর থেকে ভিডিওটা করা) কয়েকজন ছেলেমেয়ে কোলে করে দুটা ছেলেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একজনের মাথা ফেটেছে সম্ভবত, শার্ট ছেড়া, রক্তাক্ত, তবে তখনও জ্ঞান আছে। আরেকজন পুরো নিস্তেজ। গুলি খেয়ে থাকতে পারে। গলি দিয়ে তারা ছুটছে কোন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তারপরে কি জানি না, এই গলির পরে কি হাসপাতাল আছে? নিয়ে যেতে পেরেছে? বাঁচাতে পেরেছে? জানি না। এরপরে, একটা সাজোয়া যানের উপরে একটা নিথর দেহ (মৃত, নাকি তখনও আয়ু আছে বুঝার উপায় নেই) নিয়ে যাওয়ার ভিডিও দেখলাম। আরেকটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একই রকম (বা একই) সাজোয়া যানের উপরে থাকা নিথর দেহটাকে রাস্তার ডিভাইডারের উপর দিয়ে টেনে নামিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো! দেহটা রাস্তার উপরেই অবজ্ঞায়-অবহেলায় ওভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকলো! আবু সাঈদকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মারার ভিডিওটা দেখলাম! অনেকেই লিখেছেন, তাই বর্ণনায় যাচ্ছি না। আমি কোনভাবেই আসলে মেলাতে পারলাম না, কিভাবে একজন পুলিশ এত ঠাণ্ডা মাথায় একজনকে গুলি করে মারতে পারে! কিভাবে সম্ভব? আমার মনে হচ্ছিলো, বিচ্ছিন্ন ঘটনা এটা, কোন একজন পুলিশের অতি উৎসাহে গুলি ছুড়া হতে পারে, কিংবা হুট করে এক্সিডেন্টালি ট্রিগারে চাপ পড়ে যেতে পারে! পুলিশের সাথে মারামারি লাগলে, ছত্রভঙ্গ করতে দূর থেকে রাবার বুলেট ছোড়ার কাজটা পুলিশ করতে পারে বা করে, তাই বলে একদম কাছ থেকে নিরীহ একজনের উপরে এভাবে গুলি ছুড়তে পারে- বিশ্বাস করা কঠিন! কিন্তু, পরের ভিডিওগুলো দেখে ভুল ভাঙ্গলো! একটা ভিডিওতে দেখলাম, কয়েকজন পুলিশ রাস্তা দিয়ে একদিকে ছুটছে, সম্ভবত আন্দোলনকারীদের দিকে। তারা সেদিকে টিয়ার শেল, গুলিও ছুড়ছে। সেই রাস্তার পাশেই একটা দেয়াল, দেয়ালের ওপারে বিল্ডিং এর বারান্দার মত একটা প্যাসেজ দিয়ে একটা ছেলে দৌড়াচ্ছিলো। ছেলেটা জানের ভয়ে দৌড়েই পালাচ্ছিলো, হাতে লাঠি-ইট কিছুই নাই। রাস্তায় থাকা পুলিশগুলোর মধ্যে একজন ছেলেটাকে দেখতে পেরে, এগুতে এগুতেই তার বন্দুকটা ঠাণ্ডা মাথায় পলায়নরত ছেলের দিকে তাক করে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছুড়লো। কয়েকবার ছুড়তে ছুড়তেই ছেলেটার গায়ে লাগলো, ধাপাস করে পড়ে গেলো! তারপরে আর কোন ভিডিও নাই। জানতে পারলাম না, ছেলেটা গুলি খেয়ে কি ওখানেই পড়ে ছিলো? কেউ কি তাকে উদ্ধার করতে এসেছিলো? বেঁচে আছে, নাকি মরে গিয়েছে?
সবার শেষের ভিডিওটা সবচেয়ে ভয়ানক! এমন কিছু এই “স্বাধীন” বাংলাদেশেও যে সম্ভব, না দেখলে কল্পনাও করতে পারতাম না! একটা রাস্তার মাথায় অনেকগুলো পুলিশ ওপেন ফায়ার করছে, সবাই ছুটে পালিয়েছে। এরই মধ্যে একটা ছেলে গুলি খেয়েছে, আরেকটা ছেলে তার পেছন থেকে দুহাতের নীচ দিয়ে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে টেনে টেনে পেছন দিকে হেঁটে নিয়ে যাচ্ছে। গুলি খাওয়া ছেলেটার তখনো বোধ হয় জ্ঞান ছিল, তবে তার ছুটে পালানো বা হাটাচলার সামর্থ্য ছিল না, তাকে যেভাবে ধরে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো, সেভাবেই সম্ভবত পা ফেলছিলো। পুলিশগুলো তাদের দিকেই বন্দুকগুলো তাক করে রেখেছে। বন্দুক কয়েকবার উঠানামাও করালো বোধ হয় একটা পুলিশ, সম্ভবত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার তাগাদা দিতে। আমি বিস্ময়াভূত হয়ে দেখতে থাকলাম, পুলিশের গুলি, সমস্ত রকম ভয়ভীতি উপেক্ষা করে, কিভাবে ঐ ছেলেটা টেনে টেনে একটু একটু করে আরেকজনকে নিয়ে পিছনদিকে হাঁটছে! যখন কয়েক মিটার দূরে, হতবাক হয়ে দেখলাম, তাদের উদ্দেশ্যে পুলিশ আবার গুলি করলো! কিভাবে এটা সম্ভব? অলরেডি একজন গুলি খেয়েছে, আরেকজন তাকে প্রাণান্ত চেস্টা করছে বাঁচানোর, এসময়ে কিভাবে গুলি করতে পারে! প্রথম গুলি পায়ের সামান্য পাশে একটু ধুলা উড়ালো। তারপরের গুলি সম্ভবত ঐ আহত ছেলের গায়েই লাগলো, কেননা এরপরে সেই ছেলেটা একদম পুরোপুরি হাত পা ছুড়ে দিয়ে নিথর হয়ে যায়। তখনও অন্য ছেলেটা তাকে ধরে রেখেছে, বুকে দুহাতে জড়িয়ে ওভাবেই ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে টানার চেস্টা করছে! খুব যে দ্রুত টানতে পারছে, তাও নয়! তার উপরে, পুলিশের গুলির ভয়টাও আছে, তখনো আশেপাশে অন্য কেউ নেই, সামনে পুলিশ বন্দুক তাক করেই আছে! এরকম কিছুক্ষণ চেস্টা করার পরে, অবশেষে একজন সাংবাদিক কাছে গেলো, সাংবাদিক বুঝতে পারলাম- তার পরনে থাকা প্রেস লেখা বুলেটপ্রুফ ভেস্ট দেখে। সাংবাদিকটা দুজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর কয়েক সেকেণ্ড পরেই, সেই ছেলেটা, যে এতক্ষণ সাহস নিয়ে আহত ছেলেকে টেনে নিয়ে আসছিলো, সে সঙ্গীকে ছেড়ে দিয়ে, সেখানেই ফেলে রেখে – নিজ প্রাণের মায়ায় উল্টো ফিরে জানপ্রাণ দিয়ে এক দৌড় দিলো! হয়তো, ভেবেছে – আরেকজন যে এসেছে সে বাঁকি দায়িত্ব পালন করবে! কিংবা, নিজের প্রাণের ভয়টা তখন তাকে পেয়ে বসেছে! ভিডিও’র পরে কি হলো জানতে পারিনি। গুলি খাওয়া ছেলেটিকে কি সেখান থেকে সরানো সম্ভব হয়েছিলো? হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো? বাঁচতে পেরেছিলো? যে ছেলেটি শেষ পর্যন্ত আহত সঙ্গীকে ফেলে রেখে নিজের জান নিয়ে দৌড়ে পালালো, তার মানসিক অবস্থা কেমন? তার সাথে দেখা হলে সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, তার এতটুকু অপরাধবোধে ভুগার দরকার নাই, সে তার সর্বোচ্চ চেস্টাটুকুই করেছে, পুলিশ যেভাবে আহতকে রক্ষার চেস্টার মুহুর্তেও গুলি চার্জ করেছে, তাতে ওভাবে ছুটে নিজের জান বাঁচানোর চেস্টা করার মাঝে কোন ভুল নেই!
পুলিশের এভাবে নিরীহ আন্দোলনকারীকে টার্গেট করে গুলি করার কোন ব্যাখ্যা, কোনরকম যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না! অন্য কোন দেশের সাথে যুদ্ধ তো লাগেনি! নিজ দেশের মানুষ, বয়সেও তাদের সন্তানের সমান বা সন্তানের চাইতেও ছোট! পুলিশগুলো কেন এভাবে গুলি করছে, কিভাবে পারছে? নিজ দেশের মানুষের ওপরে এত রাগ কিভাবে কোথা থেকে তারা পেলো? পাকিস্তানী পাক হানাদাররা যেভাবে সার বেঁধে লাইন করে এদেশের নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষকে গুলি করে মেরেছিলো, তার সাথে এমন নির্বিচারে গুলি করার পার্থক্য কোন জায়গায়? একাত্তরে আমার আপন দাদির দুই ভাইকে (বাবার মামা) ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। তার পরে ব্রাশ ফায়ার করেছিলো। এক দাদা মারা গেলেও, আরেকজন সেখান থেকে একমাত্র জীবিত হিসেবে বেঁচে ফিরেছিলেন। প্রথমবার ব্রাশ ফায়ার করার সময়ে তিনি তার ভাইয়ের বুকে হাত বাড়িয়েছিলেন, সেই গুলি তার হাত ভেদ করে ভাইয়ের বুকে লাগে। ভাইয়ের সাথে সাথে তিনিও হাতে গুলি খেয়ে পড়ে যান, জ্ঞানও হারান। অন্য যাদের গুলি লাগেনি, তারা দাঁড়িয়েই ছিলো, তাদরকে পরের দফায় গুলি করে মারা হলেও, তিনি অজ্ঞান অবস্থায় ওখানে অনেকক্ষণ পড়ে ছিলেন, পরে জ্ঞান আসলে একা ফিরেন। ছোটবেলা থেকে এই গল্প অসংখ্যবার শুনেছি! বিভিন্ন নাটক সিনেমাতেও পাক হানাদারদের এরকম সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলার চিত্রায়ন (অভিনয়) দেখেওছি। ঠিক সেই অধ্যায়ই যেন এই ক’দিনে “স্বাধীন” বাংলাদেশে চিত্রিত হলো! পাক হানাদার বাহিনীর জায়গায় কেবল অবস্থান করছে এদেশের পুলিশ! ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা, খুন করার ধরণে এতটুকু পার্থক্য নেই, কেবল একটাই তফাৎ। পাক হানাদাররা মেরেছিলো বিজাতীয় জনতাকে, আর “স্বাধীন” বাংলাদেশের পুলিশ মারলো তাদেরই “স্বজাতি”কেই! “দলীয় কোটা”য় নিয়োগ পাওয়া এই পুলিশ বাহিনী স্বৈরাচার শেখ হাসিনার কতটা অনুগত হলে, নিজ জাতি – নিজ সন্তানের বুকে এভাবে গুলি ছোড়া সম্ভব?
এই ভিডিওটা দেখার পর থেকে, এটা কোনভাবেই মাথা থেকে দূরে সরাতে পারছি না! বারেবারে চোখে ভাসছে, একটা ছেলে আরেক গুলি খাওয়া ছেলেকে বুকে ধরে টেনে হাঁটছে আর একদল পুলিশ তাদের দিকে বন্দুক তাক করে থকতে থাকতে- তাদের গুলিই করে ফেললো! শেখ হাসিনা কিভাবে রক্ত ঝরিয়ে গদি আঁকড়ে ধরলো, কিভাবে পারলো? প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণায় গা আমার জ্বলে যাচ্ছে। বিচার চাই, পদত্যাগ চাই, পতন চাই – এমন শ্লোগানগুলোকেও পানসে মনে হচ্ছে, বাজে মনে হচ্ছে! প্রতিশোধের বাইরে অন্য কোন কিছুই মাথায় আসছে না! শেখ হাসিনা আর তার বিভিন্ন বাহিনীর প্রতি প্রবল ঘৃণায় বমি বের হচ্ছে! হিটলারকেও এত ঘৃণা করিনি, এমনকি ৭১-এর রাজাকারদের প্রতিও এত ঘৃণা ছিল কি না – এখন বলতে পারবো না। গোলাম আযমের ফাঁসীর রায় না হয়ে যাবজ্জীবন হওয়ায় খুবই ক্ষুব্ধ ও আহত হয়েছিলাম, বৃদ্ধ অবস্থায় আরাম আয়েশে গোলাম আযমের স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার পরে, আফসোস করে লিখেছিলাম, ফাঁসী দিয়ে মারা সম্ভব হলো না। নিজামী – সাঈদীর ফাঁসীতে উল্লাস করেছিলাম – এই পরিমাণ ঘৃণা ছিল গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদীসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি। শেখ হাসিনার প্রতি (ও তার মন্ত্রী-এম্পির প্রতি, ছাত্রলীগের প্রতি) এখন ঘৃণা এতটুকুও কম নেই।
[এখানে পুলিশ বলতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আর্মি, হেলমেট-ভেস্ট পরিহিত ছাত্রলীগ – রাষ্ট্রীয়/ দলীয় বাহিনীর সবাইকেই বুঝিয়েছি।]